রাস্তার পাশের দেয়ালে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের এক টুকরো প্রতিচ্ছবি। শিল্পীর রঙ-তুলির আঁচড়ে এতে স্থান পাচ্ছে বাংলাদেশের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠতম গৌরব ও অহঙ্কারের দিন।
আঁকা হচ্ছে জাতীর জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রোট্রেটসহ ভাষা সৈনিকের ছবিও। স্বাধীনতার ৫০ বর্ষপূর্তি উপলক্ষে নরসিংদীর শিল্পকলা একাডেমীর সামনের রাস্তার দুই পাশের দেয়ালকে এভাবেই রাঙিয়ে তোলা হয়েছে বিজয়ের রঙে। নরসিংদী জেলা প্রশাসনের সহযোগীতায় স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে কাজ করছে বাধঁনহারা একাডেমির একদল তরুণ চিত্র শিল্পীরা।
তারা দিন রাত অক্লান্ত পরিশ্রমে দেয়ালের ক্যানভাসকে বাঙ্গালির গৌরবের ইতিহাস দিয়ে রাঙ্গানোর কাজ করছে।
ছবি বা চিত্র যা কিনা মানুষের আবেগ-অনুভূতি অনায়েশে তুলে ধরতে পারে। খুব সহজে অতীত ও বর্তমানকে বন্ধী করে রাখতে পারে। পূর্বের গ্রাম বাংলার জীবন এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের কথা, ছবি অকপটে বলে দিতে পারে। এজন্যই এক ঝাঁক তুরুণ-তরুণী একটু একটু করে দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি ও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের নানা গৌরবগাঁথা তাদের হাতের রং তুলির ছেুাঁয়ায় দেয়ালের ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলছে। রাস্তার দুই পাশের ৮০টি অপরিষ্কার দেয়াল গুলোকে ধুয়ে-মুছে দিনরাত এক করে তারা সৌন্দর্যবর্ধনে কাজ করছে।
তারা দেযাল চিত্রের ক্যানভাসকে ৫টি ভাগে বিভক্ত করে চিত্র অঙ্কনের কাজ করছে। তরুণ চিত্র শিল্পীরা রঙ তুলির মাধ্যমে বাঙ্গালি জাতির গৌরবময় ইতিহাস বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, বাঙ্গালির ঐতিহ্যবাহী সকল উৎসব, ষড়ঝতু ও শৈশবের দূরন্তপনা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
বুধবার সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, জেলা শিল্পকলা একাডেমীর সামনে নরসিংদী বিয়াম স্কুল, পাশে জেলার মুক্তিযোদ্ধাদের ভবন আর পিছনে জেলার ব্যবসায়ীদের সংগঠন নরসিংদী চেম্বার অব কর্মাস এন্ড ইন্ডাস্ট্রির ভবন অবস্থিত। এখানে রাস্তার দুই পাশের দেয়াল গুলোতে কয়েকটি দলে বিভক্ত হয়ে ১২ থেকে ১৫ জন তরুণ- তরুণী চিত্র অঙ্কনের কাজ করছে। একদল ময়লা দেয়ালগুলোকে ঘষে পরিষ্কার করে সাদা রঙ করতেছে, আরেক দল চিত্র অঙ্কন করার জন্য নকশা করতেছে আরেক দল রঙ এর মিশ্রণ করে কাঙ্খিত রং তৈরী করতে।
গত ১৮ মার্চ সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তারা দেয়াল অঙ্কনের কাজ করছে। কোনো দেয়ালে পাখির কিচিরমিচির। কোনো দেয়ালে পহেলা বৈশাখ। কোনো দেয়ালে বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের চিত্র। মুক্তিযুদ্ধ, মানচিত্র, নদীর পাল তোলা নৌকা, কৃষকের ধান কাটা, বাউল গান সহ বিখ্যাত চিত্রও স্থান পেয়েছে কোনো দেয়ালে। প্রতিটি চিত্রই নজড় কাড়ছে সাধারণ মানুষদের।
কথা হয় চিত্রশিল্পী আতিফ এর সাথে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমরা আমাদের নিজেদের ভালোলাগা থেকে দেয়াল অঙ্কনের কাজ করতেছি। আগের ময়লা দেয়ালগুলোতে আমরা রঙ-তুলির মাধ্যমে রাঙিয়ে তোলছি।
আরেক চিত্রশিল্পী ঝুমন সরকার বলেন, আমাদের অনেক গর্বের ইতিহাস ও গ্রামীণ ঐতিহ্য রয়েছে। বাঙ্গালি জাতির গর্বের ইতিহাস ও গ্রামীণ ঐতিহ্যকে চিত্রের মাধ্যমে আমরা সবার কাছে তোলে ধরতে চেয়েছি। এজন্য পরিত্যক্ত দেয়ালকে আমরা ক্যানভাস হিসেবে বেছে নিয়েছি। যাতে আমাদের চিত্রের মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে জানতে পারে।
দেয়ালে একটি শিশুর টায়ার খেলার চিত্র অঙ্কন করছিলেন আসিফ আহসান শাহীন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমানের শিশুদের আমাদের গ্রামীণ খেলা সম্পর্কে কোন ধারণা নেই। তারা এখন ঘরে বসে কম্পিউটার ও মোবাইলে গেম খেলে সময় পার করে। তাই শিশুদের আমাদের গ্রামীণ ঐতিহ্য ও সকল খেলা সম্পর্কে জানানোর জন্য শৈশবের চিত্র অঙ্কন করা হচ্ছে।
একটি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষিকা রতn সরকার নবান্ন উৎসবের একটি দেয়াল চিত্রের দিকে অপলক দৃষ্ঠিতে তাকিয়ে ছিলেন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, দেয়াল চিত্রের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণের জন্য গ্রামে ফিরে গিয়েছিলাম। দেয়াল চিত্রের প্রতিটি বিষয় আমাদের জীবনের সাথে জড়িত। রাস্তার পাশের দেয়ালগুলোতে চিত্র অঙ্কনের ফলে রাস্তার যেমন সৌন্দর্য বাড়ছে তেমনি মানুষ চিত্রগুলো থেকে শিক্ষা ও গ্রহণ করতে পারবে।
দেয়াল চিত্র গুলোর তত্তাাবধায়ন করছে বাধঁনহারা একাডেমীর প্রশিক্ষক কামরুজ্জামান তাপু। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আমরা শহরের মানুষেরা গ্রামকে ভুলে যাচ্ছি। গ্রামের মনমুগ্ধকর প্রকৃতি ও শৈশবের কাটানো সেই দিন গুলোর কথাও ভুলে যাচ্ছি।
নতুন প্রজম্মের ছেলে মেয়েরা যাতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, গ্রামীণ জীবন, শৈশব, বাঙ্গালির পহেলা বৈশাখসহ নিজ মাতৃভূমির সম্পর্কে জানতে পারে সেই লক্ষ্যেই মাননীয় জেলা প্রশাসক সৈয়দা ফারহানা কাউনাইন এর নির্দেশনায় দেয়াল চিত্র তৈরি করা হয়েছে।