টেঁটা মাছ শিকার করার যন্ত্রবিশেষ। লোহার তৈরি এ জিনিসটির একটি প্রান্ত সূচালো থাকে। সূচালো প্রান্তটিতে একটি বাঁকানো অংশ থাকে দেখতে অনেকটা বড়শির মত।
প্রাচীনকাল থেকেই টেঁটা মাছ শিকারে ব্যবহার হয়ে আসছে। কিন্তু সভ্যতার ক্রমবিকাশে টেঁটা নামক জিনিসটি এখন শুধু মাছ শিকারে নয় মানুষ মারার কাজেও ব্যাপকভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে।
নরসিংদী সদর উপজেলার নজর পুর, করিমপুর, ইউনিয়ন, মাধবদীর বেশ কিছু গ্রাম ও রায়পুরা উপজেলার চরাঞ্চল নিলক্ষ্যা সহ আরো কিছু এলাকায় গ্রামীণ আধিপত্য বিস্তার বা পাড়া মহল্লায় ঝগড়াতে প্রতিপক্ষ কে আক্রমণ করার জন্য টেঁটার ব্যবহার প্রসিদ্ধ।
নরসিংদী জেলার তিনটি এলাকায় পরপর তিনদিন টেঁটা যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে।
১৫ মার্চ রায়পুরা উপজেলার মুছাপুর ইউনিয়নে , ১৯ মার্চ নরসিংদী সদর উপজেলার চরদিঘলদী ও নজর পুর ইউনিয়নে টেঁটা যুদ্ধ হয়।
এ টেঁটা যুদ্ধে নজর পুর ইউনিয়নের নজরপুর ও আলীপুর গ্রামের মধ্যকার ঘটনাটি চাঞ্চল্যকর।
গত ১৮ মার্চ আলীনগর গ্রামে চলছিল ওয়াজ মাহফিল। ওয়াজকে কেন্দ্র করে বসেছে হরেক রকমের দোকান। দোকানগুলির মধ্যে একটি হলো লটারির কুপণের মাধ্যমে ডিম পুরস্কার। এ ডিম নিয়েই যত বিপত্তি। ডিম নিয়ে তর্কাতর্কির মাত্রা বেড়ে গেলে তা রুপান্তর হয় টেঁটা যুদ্ধে। আহত হন জুবায়ের(২২) নামের এক অমায়িক কিশোর। আহত হওয়ার ১৯ মার্চ বিকেল ৪:৩০ মিনিট নাগাদ ঢাকা সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন জোবায়ের ।
২০ মার্চ তার ময়নাদতন্ত শেষে দাফন করা হয়। এ ঘটনায় এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।
জোবায়েরকে গলায় টেঁটা বিদ্ধ করা হয় এবং মাথায় ভারি কোনো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হলে তার গলার কয়েকটি রক্তনালী ছিঁড়ে যায় এবং মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী নজরপুর গ্রামের আদনান শরীফ ও আলীপুর গ্রামের কয়েকজন জানান, নজরপুর গ্রামের আমীর আলীর ছেলে তানভীর (১০) লটারিতে ডিম পান কিন্তু লটারির পরিচালক তানভীর(১০) কে ডিম দিতে আপত্তি করেন। এ নিয়ে উপস্থিত কয়েকজনের মধ্যে বাকবিতণ্ডা ও মারামারি শুরু হয়। এ ঘটনার খবর পেয়ে নিহত জুবায়ের(২২) ঝগড়া থামানোর জন্য এগিয়ে যান। কিন্তু ঝগড়া থামানোর বদলে আলীপুর গ্রামের সুলতান মিয়ার ছেলে সিরাজ(৪৫) ,বাবুল(৫০), কাঞ্চন মিয়ার ছেলে বিরাজ(৪০) জোবায়ের কে গ্রুপ করে পিটাতে থাকে এবং হত্যার উদ্দেশ্য তারা জুবায়েরের গলায় টেঁটা বিদ্ধ করে এবং মাথায় জোরে জোরে আঘাত করে।
এতে জোবায়ের মারাত্মক জখম হন। তাকে ওখান থেকে উদ্ধার করে নরসিংদী সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে কর্তব্যরত ডাক্তার প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ঢাকা পাঠানোর নির্দেশ দেন। ঢাকায় একদিন মুমূর্ষু অবস্থায় থাকার পর জোবায়ের মৃত্যু বরণ করেন।
জুবায়ের নজর পুর গ্রামের ছাত্তার মিয়ার ছেলে। সে বিদেশগমনেচ্ছু ছিল। টেঁটা তার অনাবিল জীবনের প্রশান্তি কেড়ে নিল।
জুবায়েরের মৃত্যুর খবর প্রচারিত হলে এলাকায় আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়। এলাকার মানুষ অশ্রুসিক্ত নয়নে শেষ বিদায় জানান। জানাযায় কয়েক হাজার মানুষ উপস্থিত হন।
এলাকাবাসীরা বলেন, আমরা আর কোনো সংঘর্ষ চাইনা। টেঁটা আজীবনের জন্য নিষিদ্ধ করা হোক। সভ্য সমাজে এমন ঘটনা মানায় না। আমরা শান্তি চাই সংঘাত নয়। আর কোনো মায়ের বুক খালি হোক এটা আমাদের কাম্য নয়। এ ব্যাপারে প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্থায়ী সমাধান আমাদের দাবি।
জুবায়ের হত্যার সাথে জড়িত সকলকে অনতিলম্বে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার জন্য জোর দাবি জানাচ্ছি।
জুবায়েরের মৃত্যুর পর আলীপুর ও নজরপুর গ্রামের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে দুই গ্রামের লোকজনই আক্রমণ পাল্টা আক্রমণ করেন।
আলীপুর ও নজরপুর গ্রামের অনেকের সাথে কথা হয় আমাদের। দুই এলাকায় ঘুরে হাল সুরত পর্যবেক্ষন করা হয়। বর্তমানে দুই গ্রামের সংযোগ পথে পুলিশি পাহারা বসানো হয়েছে।
কালকের সংঘর্ষের একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, সংঘর্ষ চলাকালে আলীপুর গ্রামের মোতালিব মিয়ার ছেলে আমিরুল ও নাম না জানা আরেকজন অবৈধ পিস্তল নিয়ে নজরপুর গ্রামের লোকজনকে উদ্দেশ্য করে এলোপাতারি গুলি ছুঁড়ে। গুলিতে কেউ হতাহত হয়নি। কিন্তু টেঁটার আঘাতে কয়েকজন মারাত্মক জখম হয়েছে। তারা প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে বাড়িতেই অবস্থান করছেন।
বর্তমানে দুই গ্রামেই থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে কড়া পদক্ষেপ।
জুবায়েরের জানাযায় নজরপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বাদল সরকার বলেন, জুবায়ের এ অকাল মৃত্যু আমাদের ব্যথিত করেছে। আজকের দিনে এমন ঘটনা অনাকাঙ্ক্ষিত। সামনের দিনগুলিতে যাতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না হয় সেদিকে আমাদের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। জুবায়ের হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি দিতে প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। দ্রুত তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হবে।
জোবায়ের হত্যায় তার চাচা বাদী হয়ে নরসিংদী মডেল থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় আলীপুর গ্রামের সুলতান মিয়ার ছেলে সিরাজ মিয়াকে প্রধান আসামী করে মোট নয়জনকে আসামী করা হয়।