উঠছে দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগ
গত ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশে নতুন রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাধাহীন উন্মুক্তভাবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর সভা সমাবেশ শুরু করে। মনোহরদীর রাজনৈতিক অঙ্গনেও সৃষ্টি হয় নতুন প্রাণ চাঞ্চল্য। দীর্ঘদিন ধরে অনুমতির বেড়াজালে আবদ্ধ থাকা ধর্মীয় ওয়াজ মাহফিল আয়োজনের পথও উন্মুক্ত হয়। বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যক্রমগুলো শুরু হয় নয়া উদ্যমে। ১৫ বছরের অবরুদ্ধ দশা থেকে মুক্তি পেয়ে রাজনৈতিক মিছিল সমাবেশ ব্যাপকভাবে গতিশীল হয়। সব রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে মুক্তির আনন্দ ও উদ্দীপনা দেখা দেয়।
মনোহরদীতে দীর্ঘদিন রাজনৈতিক অধিকার বঞ্চিত বিএনপির সম্ভাব্য এমপি প্রার্থীরা গণ সমাবেশের আয়োজন করছে। স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে নতুন গণসংযোগ তৈরি হচ্ছে। পিছিয়ে নেই জামায়াতে ইসলামীও। মুক্ত পরিবেশে প্রতি ইউনিয়নে চলছে গণসংযোগ, সমাবেশ। দীর্ঘ ১০ বছর পর মনোহরদের মাটিতে আগমন ঘটে জনপ্রিয় বক্তা আবুল কালাম আজাদ বাশারের। আয়োজন হয় ইসলামিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানেরও। কিন্তু এমন উন্মুক্ত পরিবেশে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সভা সমাবেশ আয়োজনের সুযোগ থমকে দেয়ার নতুন চিন্তার ঘনঘটা তৈরি করে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসন।
মনোহরদী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) হাছিবা খানের সভা সমাবেশ আয়োজনের নতুন নির্দেশনা জনমনে প্রশ্ন তৈরি করে। দীর্ঘ সময় পর উন্মুক্ত সভা সমাবেশের উচ্ছ্বাস হয় প্রশ্নবিদ্ধ। উন্মুক্ত পরিবেশে স্কুল-কলেজের মাঠ ব্যবহার করে যে কোন সভা সমাবেশ আয়োজনে ‘পূর্ব অনুমতির’ নির্দেশনা জারি করেন হাসিবা খান। যে প্রক্রিয়ায় বিগত সময়ে স্তব্ধ করে দেয়া হয়েছিল মানুষের রাজনৈতিক অধিকার। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী দুই মাস না যেতেই স্থানীয় প্রশাসনের এমন নির্দেশনা জনগণের মনে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। সামাজিক মাধ্যমেও শুরু হয় ব্যাপক সমালোচনা।
রাজনৈতিক ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, ছাত্র জনতার গণ বিপ্লব পরবর্তী মুক্ত পরিবেশের সঙ্গে এমন নির্দেশনা কিছুতেই যায় না। এখনো আওয়ামী প্রশাসন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় সভা সমাবেশকে অনুমতির বেড়াজালে আবদ্ধ করে রাখতে চায়। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রত্যাশার সাথে এমন নির্দেশনা সাংঘর্ষিক বলেও মনে করছেন তারা। উন্মুক্ত পরিবেশে সবার সভা সমাবেশের আয়োজনে বাঁধা তৈরির প্রচেষ্টার নিন্দা জানিয়েছেন রাজনৈতিক নেতারা।
তাছাড়া দুর্নীতিসহ বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগে উঠেছে ইউএনও -এর বিরুদ্ধে। জেলা প্রশাসন এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিব বরাবর অভিযোগ দেয়া হয়েছে স্থানীয় প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে। ইউএনও-কে পতিত স্বৈরাচারের দোসর বলেও আখ্যা দিচ্ছেন অনেকে।
এ বিষয়ে নরসিংদীর জর্জ কোর্টের আইনজীবী ও মনোহরদী পৌর বাসিন্দা অ্যাডভোকেট মারুফুল ইসলাম নরসিংদী মিররকে বলেন, মানুষের সভা সমাবেশ করার সাংবিধানিক অধিকারে কৃত্রিম বাধা সৃষ্টি করতে পারেন না ইউএনও। এটা ছাত্র আন্দোলনের অভ্যুত্থানের আশা আকাঙ্ক্ষার সাথেও সাংঘর্ষিক। আর বর্তমান ইউএনও ফ্যাসিজমের লিগেসি বহন করছেন। সম্প্রতি যুব সমাজের আয়োজনে সীরাত মাহফিল করতে বাধা দিয়েছেন তিনি। এর আগে উপজেলা স্বেচ্ছাসেবী ফোরামের কাওয়ালী ও সাংস্কৃতিক সন্ধ্যা উদযাপনেও অসহযোগিতা করেছেন।’
নতুন রাজনৈতিক পরিক্রমায় মনোহরদীতে বিএনপির তৎপরতা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। সাবেক এমপি সরদার সাখাওয়াত হোসেন বকুলের নেতৃত্বে সভা সমাবেশের পাশাপাশি মনোহরদীতে নতুন অফিস উদ্বোধন করা হয়েছে।
বিএনপির সাবেক এমপি প্রার্থী ও কেন্দ্রীয় কমিটির মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক লেফটেন্যান্ট কর্নেল(অব.) জয়নুল আবেদীনের নেতৃত্বে চলছে সিরিজ বৈঠক। নারান্দির চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে বিভিন্ন ইউনিয়ন কমিটির সাথে আলোচনা সভা অব্যাহত রেখেছেন তিনি।
অন্যদিকে বিএনপি’র নির্বাহী কমিটির স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সহ সম্পাদক আব্দুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল নিয়মিত সভা সমাবেশ করছেন। বিএনপি’র এ তরুন নেতাও আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নের প্রত্যাশা করছেন। এখন পর্যন্ত বিএনপি’র এই তিনজন হেভিওয়েট নেতাকে মনোনয়নের দৌড়ে সক্রিয় থাকতে দেখা যাচ্ছে। নিজেদের অবস্থান আর জনপ্রিয়তা জানান দিতে প্রতিনিয়ত নেতাকর্মীদের নিয়ে সমাবেশ করছেন এসব নেতারা। কিন্তু প্রশাসনের নির্দেশনা উন্মুক্ত পরিবেশের সভা করার ক্ষেত্রে নতুন প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে বলে মনে করছেন বিএনপির স্থানীয় নেতৃবৃন্দ।
স্থানীয় প্রশাসনের এমন নির্দেশনা জারির তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়ে মনোহরদী উপজেলা কৃষকদলের সভাপতি আলী আকবর নরসিংদী মিররকে বলেন, বিগত ১৫ বছর প্রশাসনের যন্ত্রণায় আমরা বাসা বাড়ির আঙ্গিনায়ও সভা সমাবেশ করতে পারিনি। এসব ইউএনও, ওসি-ডিসিরা আমাদেরকে প্রতিনিয়ত হয়রানি করতেন। এখন দেশ নতুন করে স্বাধীন হয়েছে। আব্দুল কাদির ভূঁইয়া জুয়েল ভাইয়ের নেতৃত্বে প্রতিটি ইউনিয়নের সমাবেশ শেষ করে আমরা বড় সমাবেশের চিন্তা করতেছি।
বর্তমান পরিস্থিতিতে সভা সমাবেশে কোন ধরনের বাধা সৃষ্টি হবে না বলে মনে করেছিলাম আমরা। কিন্তু নতুন রাজনৈতিক পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এমন নির্দেশনার প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাচ্ছি। তিনি এমন নির্দেশনা দিতে পারেন না।’
সরকার পরিবর্তনের পর সারা দেশের মত মনোহরদীতেও জামায়াতের সভা সমাবেশে মানুষের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মত। প্রতি ইউনিয়নে সভা-সমাবেশের পাশাপাশি মনোহরদীতে বড় ধরনের সিরাত মাহফিলের আয়োজন করে দলটি। মনোহরদী বাসস্ট্যান্ডেও গণ সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। সংগঠনের নেতারা বলছেন, কলেজ মাঠে বড় ধরনের সিরাত মাহফিল আয়োজনের পরপরই উপজেলা প্রশাসন থেকে অনুমতির নতুন নির্দেশনা জারি করা হয়। আর নির্দেশনায় প্রথমেই ওয়াজের কথা বলা হয়েছে। মূলত হয়রানি করার জন্যই এই কাজ করেছে উপজেলা প্রশাসন।
সার্বিক বিষয়ে হাসিবা খান নরসিংদী মিররকে বলেন, ৫ আগস্ট পরবর্তী পরিস্থিতিতে পরিবেশকে শান্তিপূর্ণ স্বাভাবিক রাখার জন্যই এমন নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এখানে কিছু প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছিল। গোতাসিয়া ইউনিয়নে মাজারে ওরস পালনকে কেন্দ্র করে কওমি হুজুরদের মধ্যে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে। আওয়ামী লীগ নেতাদের মাধ্যমে ওয়াজ মাহফিলের আয়োজন নিয়েও ছাত্রদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। আবার সরকারি কলেজ এবং হাতিরদিয়ায় মেলার মধ্যে জুয়া খেলার অভিযোগ আসে। এমতাবস্থায় পূর্ব অনুমতি নিলে বুঝা যায় কারা আয়োজন করছে, কি হচ্ছে। সেভাবে পদক্ষেপ নেয়া যায়। সেজন্যই অনুমতি নেয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কারো স্বার্থে আঘাত লাগায় কিংবা কারো সাথে দ্বন্দ্ব থাকায় হয়তো আমার বিরুদ্ধে বলা হচ্ছে।’
এদিকে বিগত সময়ে ক্ষমতার অপব্যবহার, নির্বাচনে পক্ষপাতিত্ব এবং দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে ইউএনও হাসিবা খানের বিরুদ্ধে। গত জাতীয় নির্বাচনের শিল্পমন্ত্রীর কাছ থেকে ৯০ লাখ টাকা আর্থিক সুবিধা গ্রহণ, উপজেলা নির্বাচনে অবৈধ লেনদেন ও অবৈধ বালু ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে টাকা নেয়ার অভিযোগে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য জেলা প্রশাসক বরাবর চিঠি দেয়া হয়েছে। চিঠিতে ইটভাটা এবং বাজার কমিটি থেকে বিভিন্ন দিবসে চাঁদাবাজির অভিযোগও করা হয়। মনোহরদী উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি কাজী শরিফুল ইসলামের পক্ষ থেকে এমন অভিযোগ দায়ের করে গত সেপ্টেম্বর মাসের ১৭ তারিখ জেলা প্রশাসন বরাবর চিঠি দেয়া হয়। সর্বশেষ গত ১৪ অক্টোবর মন্ত্রীপরিষদ সচিব বরাবর একই অভিযোগ দাখিল করেছেন মনোহরদী উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি কাজী শরিফুল ইসলাম শাকিল।
এসব অভিযোগ দায়েরের বিষয়ে জানতে চাইলে মনোহরদী উপজেলা প্রেসক্লাবের সভাপতি কাজী শরিফুল ইসলাম বলেন, এ কর্মকর্তা সরাসরি আওয়ামী লীগের দালাল। তিনি নানা অনিয়মের সাথে জড়িত। মনোহরদী উপজেলাকে তিনি দুর্নীতির স্বর্গরাজ্য বানিয়েছেন। বিভিন্ন বাজারে নতুন করে টাকা নিয়ে অনিয়মের মাধ্যমে ইজারা দিচ্ছেন। বিপ্লব পরবর্তী স্বাধীন দেশে এরকম নোংরা মানসিকতার কর্মকর্তা থাকা অশোভন, এটি শহীদদের প্রতি চরম বেইমানি।
দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে জানতে চাইলে হাসিবা খান বলেন, ‘মনোহরদীতে কোন বালুমহলের অনুমোদন নেই। অবৈধ কিছু বালু উত্তোলনের কার্যক্রম বন্ধ করে আমরা নিলামে তুলে দিয়েছি। এছাড়া ভিত্তিহীন বিভিন্ন বিষয়ে অভিযোগ আকারে নিউজ করছেন সাংবাদিক কাজী শরিফুল ইসলাম। এর আগেও বিভিন্ন প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সাথে তিনি একই কাজ করেছেন। একসময় মন্ত্রী পুত্রের সাথে চলাচল করলেও এখন আবার তার বিরুদ্ধে লেখালেখি করছেন।’
স্থানীয়রা বলছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের সব ধরনের সভা সমাবেশে তিনি প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করতেন। রাজনৈতিক সামাজিক স্কুল-কলেজের সব প্রতিষ্ঠানের একক আধিপত্য ছিল। এমনকি শিল্পমন্ত্রীর প্রোগ্রামেও নিজের দাপট ধরে রাখার চেষ্টা করতেন। কিন্তু পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে রাজনীতি তার আপন গতিতে চলছে। যেখানে বিগত আওয়ামী সরকারের প্রশাসন অনেকটাই গুরুত্ব হারিয়েছে। যা মানতে পারছেন না প্রতাপশালী এই উপজেলা কর্মকর্তা। ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় সভা সমাবেশে অতিথি হিসেবে নিজের অবস্থান ধরে রাখার জন্য “অনুমতির” নতুন নির্দেশনা জারি করেছেন তিনি।
উল্লেখ্য, গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর নির্বাচনের প্রাক্কালে তিনি মনোহরদীতে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এর আগে শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলার ইউএনও ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এসিল্যান্ড হিসিবে কর্মরত ছিলেন তিনি । তার স্বামী আবু সাঈদ শামীম শরীয়তপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদে কর্মরত। শেখ হাসিনার সময়ে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় চাকরিতে যোগদান করেন ৩৪ বিসিএসের এ কর্মকর্তা।