করোনায় এবারের ঈদে বাবুরহাটের বাবুদের চিরচেনা সেই বাবুগিরি হারিয়ে গেছে। করোনার প্রভাবে স্তব্ধ দেশের সবচেয়ে বড় পাইকারী কাপড়ের হাট। তাই হাটে নেই ক্রেতা-বিক্রেতাদের আনাগুণা। ফলে থমকে গেছে বাজারের চিরচেনা রুপ। তবে রমজানের পূর্ব মুহুর্ত্ত থেকে লকডাউনের ফলে গনপরিবহন বন্ধ থাকায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ক্রেতা সমাগম কম হয়েছে। ঈদকে ঘিরে প্রতি সপ্তাহে লেনদেন হয় ১ হাজার কোটি টাকা। লকডাউনের ফলে তা শতকোটি টাকায় নেমে এসেছে।
ব্যবসায়ীরা জানায়, ১৯৩৪ সালে জমিদার হলধর সাহা প্রায় ১১ একর জমির উপর হাটটি প্রতিষ্ঠা করে। অল্প সময়ের মধ্যেই বাবুরহাট দেশব্যাপী খ্যাতি অর্জন করে। বর্তমানে এ হাটে ৫ হাজারেরও অধিক দোকান আছে। এক সময় কেবল রবিবারেই হাট বসত। এখন সপ্তাহে দুইদিন শুক্র ও শনি হাট বসে। এখানে বিক্রি হওয়া থান কাপড়, পপলিন কাপড়, ভয়েল কাপড়, সুতি কাপড়, শাড়ি, লুঙ্গি, থ্রী-পিছ, শাটিং কাপড়, বিছানা চাদর, পর্দার কাপড় থেকে শুরু করে গামছা উৎপন্ন হয় স্থানীয় তাঁত ও সহায়ক শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে। একই সঙ্গে দেশের প্রসিদ্ধ টাঙ্গাইলের শাড়ি, জামদানী, কাঁতানসহ বিভিন্ন প্রকারের কাপড়ের সম্ভারে বাবুরহাটের সংগ্রহকে করেছে সমৃদ্ধ।
এই হাট ঘিরে নরসিংদী জেলাসহ নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে গড়ে উঠেছে কয়েক লাখ তাঁতকল। একই সঙ্গে কয়েকশ সহায়ক শিল্পপ্রতিষ্ঠান। প্রতি বছর রোজার এক সপ্তাহ আগে থেকেই ঐতিহ্যবাহি এই কাপড়ের বাজারটিতে বেচাকেনা শুরু হলেও গত দুই বছর ধরে পাল্টে গেছে এই চিত্র। করোনা পরিস্থিতির কারণে দেশে লকডাউন থাকায় দেশের সকল দোকানপাট ও গণপরিবহন বন্ধ থাকায় পাইকারী ক্রেতা না আসায় নেই কাঙ্খিত বেচাকেনা।
প্রতি বছর ঈদ উপলক্ষে পাইকারদের ভিড়ে সরগরম থাকতো যে বাজার এখন সেখানে ক্রেতাশূন্য। প্রায় বেশিরভাগ কাপড়ের দোকানে বেশিরভাগ সময় ঝুলছে তালা। যারা দোকান খুলেছেন তারাও বসে বসে অলস সময় পার করছেন। ২ থেকে ৩ ভাগ ব্যবসায়ী খুচরা বেচাকেনা করতে পারলেও পুরোপুরি লোকসানের মুখে বাজারের বেশিরভাগ বিক্রেতা। ব্যাবসায়ীদের দাবী করোনা ও লকডাউনের প্রভাবে আর্থিক লেনদেন কমে গেছে প্রায় ৬০ শতাংশ।
ব্যবসায়ীরা আরও জানান, গত বছর লকডাউন থাকলেও দেশের সবখানেই কমবেশি শপিংমল ও কাপড়ের দোকানপাট খোলা ছিল এবং খুচরা বিক্রেতারা বেচাকেনা শেষে কাপড় নিতে বাবুরহাটে এসেছিলেন।
এ বছর সারাদেশেই প্রশাসনের কঠোরতার কারণে শপিংমল ও দোকানপাট বন্ধ থাকায় সারাদেশেই বেচাকেনা নেই এবং গণপরিবহনও বন্ধ ছিল। পণ্য পরিবহন চালু থাকলেও অতিরিক্ত ভাড়ার কারণে অনেকেই পাইকারী কেনাকাটা করতে আসেননি। দেশজুড়ে গণপরিবহন বন্ধ রেখে পাইকারী কাপড়ের বাজার খোলা রেখেও কোন লাভ হয়নি। বেচাকেনার যে মন্দাভাব সেটিই থেকে গেছে।
পাকিজা গ্রুপের ম্যানেজার আলমগীর হোসেন বলেন, আমরা সারা বছর রোজার মাসের বিক্রির জন্য অপেক্ষায় থাকি। এইসময় সারাদেশের পাইকাররা আমাদের কাছ থেকে কাপঁড় নিয়ে যায়। কিন্তু করোনা আমাদে পথে বসে দিয়েছে। গুপরিবহন বন্ধ থাকার কারণে কোন পাইকার হাটে আসতে পারতাছে না। যারা ও আসছে তারা খুব অল্প পরিমাণে কেনাকাটা করছে। যার কারণে গত বছরের মত এবার ও ক্ষতির আসঙ্কা করছি।
রিমা থ্রী পিছ এর মালিক মোতালিব মিয়া বলেন, বাবুরহাট মূলত পাইকারি বিক্রির হাট। রোজার প্রথম দুই সপ্তাহ আমরা দেশের বিভিন্ন স্থানের পাইকারদের কাছে পাইকারি বিক্রি করে থাকি। কিন্তু করোনার কারণে লকডাউন থাকায় আমরা তখন ব্যবসা করতে পারি নি । অামরা যেসময় দোকান খুলেছি তখন খুচরা বিক্রেতাদের সময়। আমরা পাইকারি ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি।
এবার বাবুরহাটে অনলাইনে বিক্রির সুবিধা থাকলে ও আশানুরূপ ব্যবসা হয় নি। অনলাইনে খুব কম পরিমাণে অর্ডার পেয়েছে ব্যবসায়ীরা। বিসমিল্লাহ শাড়ি ঘরের মালিক রবিউল হাসান বলেন, প্রতি রোজায় পাইকারি ক্রেতাদের উপস্থিতিতে হাট সরগরম থাকে। এবার আমরা দোকান খোলে বসে আছি কিন্তু কোন ক্রেতা নাই। অনলাইনে যা অর্ডার পেয়েছি তা খুব নগন্য । প্রতি ঈদে যেখানে আমরা প্রতিটি দোকান এক থেকে দেড় কোটি টাকা বিক্রি কওে থাকি সেখানে এবার অর্ধকোটি টাকা বিক্রি করতে পারবো কিনা তা ও সন্দেহ রয়েছে।
কুমিল্লা থেকে বাবুরহাটে কাপড় কিনতে এসেছে পাইকারি বিক্রেতা সোহেল মিয়া। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, বাবুরহাটের কাঁপড়ের সুনাম সারাদেশে রয়েছে। এখানে কাঁপড়ের মানে খুব ভালো হয়। এছাড়া একসাথে সবধরনের কাপড় এখানে পাওয়া যায়। কিন্তু করোনার কারণে আমরা ব্যবসা করতে পারব কিনা তা নিয়ে চিন্তাই ছিলাম। তাই শেষ মুহূর্তে কাপড় কিনতে এসেছি।
আরেক ব্যবসায়ী কবির হোসেন বলেন, করোনার লকডাউনের কারণে গণপরিহন বন্ধ। আমাদের বেশি ভাড়া দিয়ে হাটে আসতে হয়েছে। আবার ট্রাকের ও বেশি ভাড়া দিয়ে মাল নিযে যেতে হবে। এত বেশি খরচ করে ব্যবসায় লাভ নিয়ে টেনশনে আছি।
করোনায় এই হাটের বেচাকেনা কম থাকায় ব্যবসায়ীদের সাথে সমস্যায় আছেন এর সাথে জড়িত কুলি ও ভ্যানচালকরা। হাসান নামে এক ভ্যানচালক বলেন , প্রতি ঈদে হাটে ভ্যান চালিয়ে একের পর এক ট্রিপের কারনে একটু বিশ্রাম নিতে পারতাম না। এখন পাইকার আসেনা, খুচরা ক্রেতাদের পন্য নিজেরাই বহন করে । তাই এখন হাটে অলস বসে থাকি।
ইউনুস মিয়া কুলির কাজ করেন এই বাবুরহাটে। তিনি বলেন , আগে সারাদিনে কাজ করে শেষ করতে পারতাম না। কাজ আমার পেছনে ছুটত,এখন আমি কাজের পেছনে ছুটি। পাইকার নাই , কেনাবেচা কম । তাই কাজও নাই
নরসিংদী চেম্বার অব কর্মাস এন্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট আলী হোসেন শিশির বাংলানিউজকে বলেন, বাবুরহাটই হলো শিল্প এলাকা নরসিংদীর হৃদপিন্ড। পুরো জেলার ব্যবসায়ীরাই তাকিয়ে রয়েছে বাবুহাটের ঈদ বেচাকেনার দিকে।
এবারের ঈদে ব্যবসায়ীদের হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ রয়েছে। হাট বন্ধ থাকার পরে স্বাস্থ্য বিধি মেনে হাট খোলে দেয়া হলেও বিক্রি সন্তোষ্টজনক নয়। আমরা আশা করছি এবার হাটে শতকোটি টাকার কেনা বেচা হবে। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত ২০ হাজার মালিক ও জেলার প্রায় ও ৩ লাখ মানুষ। আমরা শ্রমিকদের সময়মত বেতন বোনাসের মাধ্যমে তাদের ছুটি দিবো। তারা যেনো সুন্দর ভাবে পরিবারের সাথে ঈদ করতে পারে।