কোটি জনতার কোলাহলে জীবন্ত শহরে শুধুই নিস্তব্ধতা। দোকানের সব শাটার বন্ধ, যেন যুদ্ধ অবস্থা। ফিলিস্তিনের গাজা, সিরিয়ার দামেস্ক কিংবা আলেপ্পো র কোন রাস্তায় কি আমরা? মাঝেসাজে পুলিশের হুইসেল বাজানো কিছু গাড়ি ছুটে চলছে। বিশাল অট্টালিকার ছোট ছোট জানালায় কোন আলো নেই। ভবনের দু একটি ফ্ল্যাটে কোনমতে বাতি জ্বলছে। বাকি সব যেন জিনের দখলে। শহরের মোড়ে মোড়ে ল্যাম্পপোস্ট গুলো অযথা আলো ছড়াচ্ছে। যে আলোতে পথিকের পথ চলার ব্যস্ততা নেই। সে আলো আর অন্ধকারের তফাৎ কিসে?
যেন ইংলিশ হরর মুভির সেই চিরচেনা কোন দৃশ্য। মোড়ে মোড়ে কিছু ভুতুড়ে হাত গাড়ির জানালার দিকে ধেয়ে আসছে। সত্যিই খুব ভৌতিক লাগছে। চলতি পথে রাস্তার দুধারে শুকনো বয়স্ক মানুষের সিরিয়াল যেন ভুতের মিছিল। বাঁকা দৃষ্টি যেন বিপদের আভাস দিচ্ছে! এখনই যেন ঘাড় মটকে রক্ত চুষে নেবে। গলি থেকে বেরিয়ে ক্ষুধার্ত কুকুরের দল যেন খাবারের দাবি জানাচ্ছে।
প্রাচ্যের অক্সফোর্ডের কুকুরের দল ঘিরে ধরেছে। কিছু না দিলে যেন ছাড়বেই না। তবে আমি দেয়াল টপকে বেরিয়ে এলেও কুকুরগুলো দেয়াল টপকানোর শক্তিও হারিয়েছে। এত দুর্বল শুকনো মুমূর্ষ অবস্থা প্রানীকুলের মধ্যে আমি কখনো দেখিনি।
হাসপাতালগুলো যেন ভাইরাসের কেন্দ্র। কেউ হাসপাতালে যেতে চাচ্ছে না। গেলেও সেখানে সেবা পাওয়া যাচ্ছিল না। হাসপাতালে গেলে সহকর্মীরাও ভয় পাচ্ছিল। একজন তো রাগ করে ভালোবেসে বলছিল আপনাকে গুলি করতে মন চায় কেন হাসপাতালে যান? কে কার থেকে কত দূরত্ব বজায় রেখে নিরাপদ থাকার চেষ্টা। নিজের আত্মরক্ষায় সতর্কতার নামে আত্মকেন্দ্রিক অমানবিকতা ও দৃষ্টি এড়ায়নি। গর্ভবতী এক নারির চিকিৎসা বঞ্চনার চাক্ষুষ অমানবিকতা দেখতে হয়েছিল। নিজেকে অনেক অসহায় লাগছিল।
এত সব সর্তকতা আর মৃত্যুর মিছিলের মধ্যেও বৃষ্টিতে ভিজে দিনের পর দিন গার্মেন্টস শ্রমিকদের আন্দোলন দেখেছি। সবার হয়তো সতর্ক থাকতে নেই জীবনের মায়া নিয়ে। তাইতো বিজিএমইএর সভাপতি বলেছিলেন আমাদের শ্রমিকরা খুব সাহসী। যেটা রোগ প্রতিরোধে অনেক বেশী কার্যকর। তাইতো তো বস্তিতে দেখেছি সামাজিক দূরত্ব এক কল্পনা সেখানে। ছোট্ট একটি ঘরে মা বাপ ছেলে ছেলের বউ নিয়ে সংসার করার কথা মাথায় চিন্তা করে কিছুটা সময় থমকে ছিলাম। সাংবাদিকতার এই ছোট্ট সময় এর চেয়ে বড় কোনো আমার মাথার উপর দিয়ে যায়নি।
সকল নিস্তব্ধতা ভেঙে দিয়ে রিক্সা চালকের ডাক শুনেছি। ভাই যাবেন? আসেন যাই। ডেকে ডেকে যাচ্ছিলেন সড়কের মানুষদের। তবে তাতেই শেষ নয়। কখনো মাঝপথে উল্টে থাকা রিক্সা দেখেছি। দায় দায়িত্ব আর বাস্তবতার দোলাচলে পুলিশকে দেখেছি। গরমের মধ্যে রোদে দাঁড়িয়ে PPE পরিহিত থাকায় হাফ প্যান্ট ভিজে যাওয়ার গল্প শুনেছি পুলিশ সদস্যের কাছ থেকে।
কিছুদিন ত্রাণের জন্য মানুষের ভিখারি অবস্থা দেখেছি। মনে হচ্ছে এ যেন ভিক্ষুকের নগরী। কে জানে কতশত হাত সামনে এসেছে আর অন্যদিকে তাকিয়ে এড়িয়ে গিয়েছি। কয়েক দশক থাকার পরেও অনেক অসহায়ের শহর ছাড়ার দৃশ্য দেখেছি। এটা যে কতটা কষ্টের তা হয়তো কল্পনার সীমার বাইরে।
হাজারো অনাকাঙ্ক্ষিত অনভিপ্রেত ঘটনার সাক্ষী হয়েছি। মৃত্যুর মিছিল যেন শুধু একটি সংখ্যা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল আমার কাছে। জীবন যেন লাশের সংখ্যার একটি সাধারণ খেলায় পরিণত হয়েছিল।
ভয়হীন থাকার চেষ্টার মধ্যেও অনেক ভয় পেয়েছি। বৃষ্টিতে ভিজার ফলে যখন জ্বরে কাতার ছিলাম। তখন নিজেকে নিজে প্রশ্ন করছিলাম। কেন এত ছুটোছুটি করছিলাম? কোথা থেকে আমি সংক্রমিত হয়েছি তা মিলানোর চেষ্টা করছিলাম। কি হবে আমার যদি আমি আক্রান্ত হই? যে সমাজে লাশের দাফন হয় না। আক্রান্ত কে কেউ জায়গা দেয় না। সে শহরে এই মেস জীবনে কোথায় যাব আমি? জানা-অজানা হাজারো সমস্যায় ভরপুর অজানা সব প্রশ্নের সমাহার। শেষ অবধি রবের কৃপায় সেরে উঠেছি ঠিকই। তবে জানার চেষ্টা করিনি আমি আক্রান্ত ছিলাম কিনা।
পৃথিবী থেকে করোনা কোনোদিন যাবে কিনা, টিকা আবিষ্কার হবে কিনা, সে কথা জানিনা, জানতে চাইও না। তবে করোনা কালে একজন মাঠের কর্মী হিসেবে ইতিহাসের চাক্ষুষ সাক্ষী থাকলাম।
স্টাফ রিপোর্টার
ভোরের কাগজ লাইভ।
লিখাটি ফেসবুক https://www.facebook.com/EE.Nakib থেকে নেওয়া