কৃষি এদেশের প্রাণ। কৃষক, খামারী আর কৃষিবিদদের অদম্য প্রচেষ্টাতেই খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণতা অর্জন করেছে এ দেশ। স্বাধীন বাংলাদেশে স্বাধীনতা পরবর্তীতেই এদেশে কৃষি আর কৃষিবিদদের গুরুত্ব ফুঁটে উঠেছিলো। এরই ধারাবাহিকতায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যায় চত্বরে এক সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু কৃষিবিদদের প্রাণের দাবি মেনে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারদের পাশাপাশি কৃষিবিদদেরও সরকারি চাকুরিতে প্রথম শ্রেণীর মর্যাদায় ভূষিত করেন।
তাই এই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতেই ২০১১ সাল থেকে কৃষিবিদ ইন্সটিটিউশান বাংলাদেশ (কেআইবি) কেন্দ্রীয়ভাবে দিনটিকে উদযাপন করে আসছে। কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা ঘোষণাকালে তিনি বলেছিলেন, ‘আন্দোলন করছিস বলে আমি দাবি মেনে নিলাম তা নয়, আমি চাই ভালো ছাত্র-ছাত্রী কৃষি পড়ুক’ আমি তোদের দাবি মেনে নিলাম তোরা আমার মুখ রাখিস।’ জাতির পিতার সেই ঘোষণার ৫০ বছর পর আজ দেশের কৃষিখাতের উন্নয়ন দেখে একজন কৃষিবিদ হিসেবে মনে হয়েছে, কৃষিবিদরা মনে হয় জাতির পিতার সেই বাণী “তোরা আমার মুখ রাখিস”–এর কিছুটা হলেও রক্ষা করতে পেরেছে।
আজ দেশের সকল ক্ষেত্রে কৃষিবিদদের সরব উপস্থিতি এবং বর্তমানে বিশ্বে বাংলাদেশ এখন কৃষিতে রোল মডেল। আজ কৃষিবিদ দিবসে আমি ব্যক্তিগত ভাবে কৃষিবিদ দিবস উপলক্ষে শিক্ষিত তরুণদের কৃষি ক্ষেত্রে উদ্যোক্তা হওয়ার আহ্বান করছি।
অনেক তরুণ চাকরির জন্য আসেন। তারা সরকারি চাকরি আর ব্যাংকের চাকরির জন্য আগ্রহ দেখান। কিন্তু কেউই কৃষক কিংবা উদ্যোক্তা হওয়ার হতে চান না। “আমাদের দেশে অনেকেই দেখি কর্মহীন প্রবৃদ্ধি নিয়ে কথা বলে। কিন্তু তরুণ সমাজ নিজে থেকে কিছু করার আগ্রহ দেখায় না। বরং বিদেশে পাড়ি জমাতে তাদের আগ্রহ বেশি।”
বাংলাদেশের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর হলেও গত দুই দশকে তা পরিবর্তিত হচ্ছে। ২০০০-২০০১ অর্থবছরে দেশের জিডিপিতে কৃষির অবদান ছিল ২০ দশমিক ৮ শতাংশ; ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা কমে দাঁড়ায় ১৪ দশমিক ১ শতাংশে। কৃষি অর্থনীতিতে ”পোশাক রপ্তানি আর বিদেশ থেকে অদক্ষ শ্রমিকদের পাঠানো রেমিটেন্সকে বড় করে দেখা হলেও বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতির মূল ভিত্তি হিসাবে কৃষি এখনও প্রধান ভূমিকায়।”
এই খাতে তরুণদের আগ্রহী করতে পরিবেশ তৈরিতে গুরুত্ব দিতে হবে “নানামুখী সামাজিক ও বাজার ব্যবস্থাপনার বাধার সম্মুখীন হচ্ছে কৃষিখাত। শিক্ষিত তরুণদের এই পেশার প্রতি যথেষ্ট অনীহা আছে। এমন একটি পরিবেশ তৈরি করতে হবে অথবা কৃষিকে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে হবে যাতে শিক্ষিত তরুণরা নতুন নতুন উদ্ভাবন নিয়ে কৃষিকাজের সঙ্গে যুক্ত হয়।
“বর্তমানে যারা কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত আছে তাদের আয় বাড়াতে এবং তারা যাতে ক্ষতির সম্মুখীন না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। তাহলে কেবল তারা স্বাচ্ছন্দে নিজের সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে পারবে এবং কৃষির প্রতি ওই সন্তানের একটা আগ্রহ সৃষ্টি হবে।” পাশাপাশি তরুণদেরও নিজে থেকে উদ্যোগী হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।“নতুন প্রজন্মের কেউ উদ্যোক্তা হতে চাইলে আগে নিজে নিজেই কাজে নেমে পড়তে হবে।
উদ্যোক্তা হওয়া মানে নিজেই নিজেইর অফিসের কর্তা বনে যাওয়া নয়। কৃষিতে তরুণদের উপস্থিতি কম হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করলে দেখা যায় “তরুণরা কেবল ঢাকায় চলে আসতে চায় অথবা মনের মধ্যে বিদেশে পাড়ি দেওয়ার বাসনা নিয়ে ঘুরে। তার কেউ কৃষিকাজে আগ্রহ পায় না। মাঠে যারা কৃষিকাজ করেন তাদের অধিকাংশের বয়স ৪০ বছরের বেশি। মাত্র ২০ শতাংশ কৃষিকর্মী পেয়েছি যাদের বয়স ৩৫ বছরের নিচে। “কৃষক এখনও সমাজে করুণার পাত্র। কেউ তাদের মর্যাদার কথা বলে না। কৃষকের সামাজিক এবং আর্থিক মর্যাদা বাড়ালে তরুণরা এইদিকে ঝাঁপিয়ে পড়বে, যেমনি ভাবে এখন সরকারি চাকরির দিকে ঝুঁকে পড়েছে।
এই অগ্রযাত্রায় হঠাৎ বাধা হয়ে আসে মহামারি কোভিড-১৯। উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় কৃষকদের। এরপর লকডাউনে অচল হয়ে যায় সবকিছু, কৃষকরা হয়ে পড়ে বেকার। এরই মাঝে ঘূর্ণিঝড়, একাধিক বন্যার মতো দুর্যোগে ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে কৃষি উৎপাদন। যার প্রভাব পড়েছে বর্তমান বাজারে। তবে করোনা মহামারিতে বিপুল খাদ্যসঙ্কটের যে আশঙ্কা করা হচ্ছিল, সেরকম কোন পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়নি দেশ।
সেজন্য আমাদের কৃষক ও কৃষিবিদরা অবশ্যই কৃতজ্ঞতা পাওয়ার যোগ্য, সেটি না বলার কোনো অবকাশ নেই। পাশাপাশি ভবিষ্যৎ কৃষির মানোন্নয়নে যুগোপযোগী কর্মপন্থা ঠিক করার এখনি সময়। সেই সাথে আমি এই দেশের তরুনদের আহ্বান করবো যেন তারা দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে কৃষিতে এগিয়ে আসে।